গঙ্গাসাগরের পৌরাণিক কাহিনী মূলত কথা বলে, জীবন ও মৃত্যুর বৃত্ত এবং মোক্ষ সম্পর্কে আর এই ভক্তির মুখ্য কেন্দ্রস্থল হল কপিল মুনির মন্দির। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, কপিল মুনির পিতা ছিলেন মহর্ষি কর্দম মুনি এবং মাতা ছিলেন পৃথিবী শাসক স্বয়ম্ভব মনুর কন্যা দেবহূতি। কর্দম মুনি তাঁর পিতা ভগবান ব্রহ্মার আদেশ অনুযায়ী কঠোর তপস্যা করেছিলেন। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সামনে আবির্ভূত হন এবং কর্দম মুনিকে স্বয়ম্ভব মনুর কন্যা দেবহূতিকে বিবাহ করতে বলেন এবং ভবিষ্যতবাণী করেন, কর্দম মুনি ও দেবহূতির ৯টি কন্যা হবে এবং সময়ের সাথে সমগ্র সৃষ্টিকে জীবিত সত্ত্বা দিয়ে পূর্ণ করবে। এছাড়াও ভগবান বিষ্ণু জানান, তিনি নিজে অবতার রূপে কর্দম মুনি ও দেবহূতির সন্তান হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন এবং সমগ্র বিশ্বকে সাংখ্য দর্শন প্রদান করবেন। কপিল মুনি প্রথম জীবনে বেদের অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন এবং সাংখ্য দর্শনকে সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ করেন।

গঙ্গাসাগরের কিংবদন্তী শুরু হয় রামায়ণের রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা সগরের উপাখ্যান দিয়ে। ইক্ষাকু বংশের রাজা সগর ঋষি ঔর্বের নির্দেশে শত অশ্ব্মেধ যজ্ঞ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কথিত ছিল, কেউ যদি শত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে তাহলে সে সমগ্র পৃথিবীতে আধিপত্য অর্জন করতে পারবে। একমাত্র দেবরাজ ইন্দ্র তার আগে শত অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন। সগরের শত অশ্বমেধ যজ্ঞের সঙ্কল্প শুনে ইন্দ্র আশঙ্কিত হয়ে পড়েন সগর সফল হলে তিনি মর্যাদা হারাবেন। ভীত ইন্দ্র, সগরের যজ্ঞের অশ্ব কপিল মুনির আশ্রমে লুকিয়ে রাখেন।

যজ্ঞের অশ্ব খুঁজে না পেয়ে ক্রুদ্ধ সগর, তার ৬০,০০০ পুত্রকে নিখোঁজ ঘোড়াটির সন্ধানে পাঠান। পথে সবকিছু ধ্বংস করতে করতে সগরপুত্ররা পৌঁছন কপিল মুনির আশ্রমে। ধ্যানরত কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছে সগরপুত্ররা অশ্বটি খুঁজে পেয়ে কপিল মুনির ধ্যানভঙ্গ করে এবং তাঁকে অপমান করে। ক্রুদ্ধ কপিল মুনি চোখ খুলে সগরের ৬০,০০০ পুত্রকে ভস্ম করে তাদের আত্মা নরকে পাঠিয়ে দেন। বহু বছর পর, সগরের বংশধর অংশুমান কপিল মুনির আশ্রমে পৌঁছে যজ্ঞের অশ্বটিকে খুঁজে পান। অংশুমান কপিল মুনিকে তুষ্ট করবার জন্য তপস্যা করেন। অংশুমানের তপস্যায় তুষ্ট কপিল মুনি অশ্বটিকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেন। কপিল মুনির কাছ থেকে অংশুমান জানতে পারেন,গঙ্গার পবিত্র জলে শ্রাদ্ধকর্মাদি করলে তবেই সগরপুত্রদের আত্মা মুক্তি পাবে। কিন্তু অংশুমান বা তার পুত্র দিলীপ কেউই গঙ্গাকে মর্তে আনতে অসমর্থ হন। দিলীপের পুত্র রাজা ভগীরথ প্রথমে ব্রহ্মা ও পরে বিষ্ণুর আরাধনা করে গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পান। সন্তুষ্ট ভগবান বিষ্ণু ভগীরথকে সতর্ক করেন, গঙ্গার গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সেই দুরন্ত বেগে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। ভগীরথ তখন ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করেন, শিব যেন তার জটায় গঙ্গাকে ধারণ করে তার বেগ নিয়ন্ত্রণ করেন। শিবের জটায় গঙ্গার দ্রুতবেগ হ্রাস পায় এবং তারপর গঙ্গা মর্তে অবতরণ করেন। অবশেষে ভগীরথ পবিত্র গঙ্গা জলে তাঁর ৬০,০০০ পূর্বপুরুষের আত্মার শ্রাদ্ধকর্মাদি করে তাদের আত্মাকে নরক থেকে মুক্ত করেন।

যযুগ যুগে এই সব পৌরাণিক কাহিনী কিংবদন্তি ও পরে কিংবদন্তি থেকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজা ভগীরথের নাম অনুসারে তাই গঙ্গার নাম হয় ভাগীরথী এস রাজা সগরের নামে সমুদ্রের নাম হয় সাগর। সমুদ্র ও নদীর মধ্যবর্তী দ্বীপের নাম হয় সাগরদ্বীপ।

পৌরাণিক এই আখ্যানে বিশ্বাস রেখে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী মোক্ষের সন্ধানে মকর সংক্রান্তির সময়ে গঙ্গাসাগর মেলায় যান। তারা বিশ্বাস করেন, সাগরসঙ্গমের পবিত্র জলে ডুব দিলে সমস্ত পাপ ধুয়ে যায়। এই বিশ্বাসে ভর দিয়ে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ কপিল মুনির মন্দির দর্শন করেন ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’।